,

করোনা মোকাবিলায় শুধু চিকিৎসক নার্স নয় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগও জরুরি

স্বাস্থ্য বিভাগে ৩০ হাজার পদ খালি

 

সময় ডেস্ক : করোনা পরিস্থিতি নিয়ে গত ২৩এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নতুন করে দুই হাজার চিকিৎসক ও ছয় হাজার নার্স নিয়োগের কথা বলেন। করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, নতুন নতুন হাসপাতাল প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, অনেককে কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়েছে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আরও দুই হাজার চিকিৎসক ও ছয় হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ ঘোষণায় চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চারিত হলেও বেকার অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে হতাশা ভর করেছে। অথচ স্বাস্থ্য খাতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, ওয়ার্ডবয়, নিরাপত্তাকর্মী, ড্রাইভার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আয়াসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৩০ হাজার পদ শূন্য পড়ে আছে। আইনি জটিলতার কারণে বছরের পর বছর ধরে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছিল না। বছর দেড়েক আগে সেই বাধা দূর হলেও এখন পর্যন্ত তাদের নিয়োগ দেওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল নিয়োগে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সাড়ে সাত লাখের মতো আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া আর অগ্রসর হয়নি। মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার চাইলে দ্রুত এসব পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। তাদের অভিমত, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা শুধু চিকিৎসক ও নার্স-নির্ভর নয়। এর সঙ্গে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, ওয়ার্ডবয়, নিরাপত্তাকর্মী, ড্রাইভার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আয়াসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরারও যুক্ত। মেডিকেল টেকনোলজিস্টের কাজ যেমন চিকিৎসক কিংবা নার্স করতে পারবেন না- একইভাবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ড্রাইভারের কাজও অন্যরা করতে পারবেন না। সুতরাং প্রত্যেকটি কাজের জন্য পৃথকভাবে জনবল নিয়োগের প্রয়োজন। এতে করে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি হাজার হাজার বেকার যুবকের ভাগ্য বিড়ম্বনারও অবসান হবে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত সারাদেশে ২২১ চিকিৎসক, ৮৮ নার্স, টেকনোলজিস্টসহ ১৯১ স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন বলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ চিকিৎসক ও নার্সের বাইরে প্রায় সমসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে সংগঠনটি বলছে, আরও দেড় হাজারের বেশি চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। এ অবস্থায় মহামারি মোকাবিলায় চিকিৎসক-নার্সের পাশাপাশি অন্যান্য জনবলেরও আনুপাতিকহারে নিয়োগ চান চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। অন্যথায় করোনা পরিস্থিতিতে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিএমএর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী সমকালকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় চিকিৎসক, নার্সের পাশাপাশি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবলও অত্যন্ত প্রয়োজন। করোনা শনাক্তকরণে ব্যাপকহারে নমুনা পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে। এই কাজটির জন্য প্রথমেই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন। অথচ বছরের পর বছর ধরে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে আছে। একইভাবে হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখতে পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও আয়ার প্রয়োজন। এমএলএসএস, ড্রাইভার, নিরাপত্তাকর্মী থেকে প্রত্যেকটি জনবলই গুরুত্বপূর্ণ।
ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী আরও বলেন, অ্যাডহক ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে। এটি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ছাড়া অনৈতিক বাণিজ্যের সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং ৩৯তম বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রায় সাড়ে আট হাজার চিকিৎসকের মধ্য থেকেই মেধাক্রম অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কারণ, তারা এরই মধ্যে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আছেন। তাদের নিয়োগ দেওয়া হলে দ্রুততম সময়ে কাজটি করা সম্ভব হবে।
৩৯তম বিসিএস উত্তীর্ণ চিকিৎসক রাফা বিনতে নূর সমকালকে বলেন, নতুন করে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের ঘোষণায় ৩৯তম বিসিএস উত্তীর্ণ চিকিৎসকদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চার হয়েছে। মহামারির এই সময়ে সেখান থেকে মেধাক্রম অনুযায়ী চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হলে তারা কাজ করবেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব সেলিম মোল্লা সমকালকে বলেন, করোনা মোকাবিলায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা সম্মুখসারির যোদ্ধা। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটি করেন। তাদের এই কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করেই রোগী শনাক্ত হয়। এরপর চিকিৎসা শুরু হয়। তখন চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন দেখা দেয়। করোনা মোকাবিলায় দুই হাজার চিকিৎসক এবং ছয় হাজার নার্স নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। দুঃখজনক হলো, করোনাযুদ্ধের প্রথম সারির সৈনিক মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। আমাদের দাবি, পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১৫ হাজার বেকার টেকনোলজিস্টকে অবিলম্বে নিয়োগ দেওয়া হোক। অন্যথায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, আর কত সমালোচনা করব। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্তাব্যক্তিরা একেক সময় একেক কথা বলেন, একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেন। দুই হাজার চিকিৎসক ও ছয় হাজার নার্স নিয়োগের সিদ্ধান্তের কথা মন্ত্রী জানালেন। স্বাস্থ্যসেবা কি শুধু চিকিৎসক, নার্স দিয়েই হবে? এর সঙ্গে অন্যান্য যেসব কর্মীর প্রয়োজন, তার কী হবে? চিকিৎসক-নার্সরা কি বাড়ি বাড়ি ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করবেন, হাসপাতাল পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করবেন, ট্রলি বহন করবেন? তাহলে কেবল চিকিৎসক আর নার্স নিয়োগের কথা কেন বলা হচ্ছে। চিকিৎসক-নার্সের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীও তো আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা একটি সম্মিলিত প্রক্রিয়া। সুতরাং তাদের নিয়োগের বিষয়টিও ভাবতে হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগে ৩০ হাজার পদ খালি :স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ২০ হাজার ৩৮৩টি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে আট হাজার ৫৯টি নন-মেডিকেল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের ৪০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঁচ হাজার ৭০৩টি পদের বিপরীতে কাজ করছেন চার হাজার ২৭ জন। এই বিভাগে এক হাজার ৬৭৬টি পদ শূন্য রয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের ৯৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চার হাজার ১৯০টি পদ খালি। ঢাকা বিভাগের ৯১টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ২০ হাজার ৯৮৭ পদের বিপরীতে কাজ করছেন ১৬ হাজার ৮২৫ জন। খুলনা বিভাগের ৬০ প্রতিষ্ঠানে দুই হাজার ৮৫৫টি, ময়মনসিংহে ৩৪ প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ৪১০টি, রাজশাহীর ৬৫ প্রতিষ্ঠানে দুই হাজার ৫০৭টি, রংপুরে দুই হাজার ১৪৮টি এবং সিলেটে এক হাজার ৪৩৫টি পদ খালি রয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতায় মেডিকেল কলেজ ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে আরও আট হাজার ৫৯টি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ খালি পড়ে আছে।
যে কারণে আটকে ছিল নিয়োগ :স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ‘স্বাস্থ্য বিভাগীয় নন-মেডিকেল কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৫’-এর আওতায় নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হতো। সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ১৯৭৯ এবং সংবিধান (সপ্তম সংশোধন) আইন, ১৯৮৬ বাতিল হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল এবং ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারিকৃত নিয়োগ বিধিমালা বা অন্যান্য বিধিমালা অকার্যকর হয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে ১৬৬টি অধ্যাদেশকে সংরক্ষণপূর্বক ওই সময়কালে জারিকৃত বিধিমালাগুলোকে নিয়ে দুটি আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ওই ১৬৬টি অধ্যাদেশের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ণিত নিয়োগ বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নন-মেডিকেল কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতি কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
তবুও থমকে আছে নিয়োগ :স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালে ওই বিধিমালা সংশোধনের স্বাস্থ্য খাতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল নিয়োগের বাধা কেটে যায়। পরের বছর নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে মন্ত্রণালয়। এ জন্য বিভাগ ও জেলা অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করা হয়। সাড়ে সাত লাখের মতো আবেদন জমা পড়ে। ওই আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছিল। এরই মধ্যে করোনা পরিস্থিতির কারণে সবকিছু থমকে গেছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খান সমকালকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল নিয়োগের কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। কারণ সাড়ে সাত লাখ আবেদনকারীর মধ্য থেকে আগে বাছাই করে পরীক্ষার আয়োজন করতে হবে। কিন্তু যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়া সম্ভব হবে না। এ কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে হয়েছে। তবে বিকল্প কী করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। টেকনোলজিস্টদের মধ্যে যারা প্রেষণে কিংবা বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি আছেন, তাদের করোনা মোকাবিলার কার্যক্রমে যুক্ত করা যায় কিনা, সেটা ভাবা হচ্ছে।
চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে হাবিবুর রহমান খান বলেন, ৩৯তম বিশেষ বিসিএস উত্তীর্ণ আট হাজারের ওপর চিকিৎসক রয়েছেন। সেখান থেকে মেধাক্রম অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া যায় কিনা, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আবার অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগের বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে। যে প্রক্রিয়াটি অধিকতর ভালো বিবেচিত হবে, সেটিই করা হবে।


     এই বিভাগের আরো খবর